ঈদুল ফিতরের গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত সমূহ
ঈদুল ফিতর শুধু একটি উৎসব নয়, এটি মুসলিম উম্মাহর জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ নেয়ামত। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ যখন আকাশে উঁকি দেয়, তখন প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়।
মাসব্যাপী সংযমের কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের পর এই দিনটি আসে খুশির বার্তা নিয়ে। তাই, ঈদুল ফিতরের প্রতিটি মুহূর্তকে ইবাদত ও সুন্নতের আলোয় উদ্ভাসিত করা আমাদের কর্তব্য।
ইসলামের প্রতিটি উৎসবের মতো ঈদুল ফিতরেরও রয়েছে কিছু সুনির্দিষ্ট সুন্নত। এই সুন্নতগুলো পালনের মাধ্যমে আমরা একদিকে যেমন আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারি, তেমনি অন্যদিকে ঈদের আনন্দকে আরও অর্থবহ করে তুলতে পারি।
আসুন, ঈদুল ফিতরের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই:
১. তাকবিরে মুখরিত হোক ঈদের সকাল
ঈদের দিনের শুরুটা হওয়া উচিত আল্লাহু আকবারের ধ্বনিতে। ফজর নামাজের পর থেকে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত উচ্চস্বরে তাকবির পাঠ করা সুন্নত।
এই তাকবির শুধু কিছু শব্দ নয়, এটি আমাদের অন্তরের গভীর থেকে উৎসারিত আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তাকবিরের মাধ্যমে আমরা ঘোষণা করি যে আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই।
তাকবিরের ভাষা: “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।”
২. পরিচ্ছন্নতা ও সুগন্ধে ভরে উঠুক মন
ঈদের দিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকাও একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। এদিন গোসল করা, সুন্দর ও পরিপাটি পোশাক পরিধান করা এবং সাধ্যমতো সুগন্ধি ব্যবহার করা মুস্তাহাব।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। তাই, ঈদের দিনে নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পাশাপাশি অন্যদের কাছেও একটি সুন্দর বার্তা পৌঁছে দিতে পারি।
৩. মিষ্টিমুখ করে ঈদের দিন শুরু
ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে মিষ্টি জাতীয় কিছু খাওয়া সুন্নত। খেজুর এক্ষেত্রে উত্তম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণত ঈদের দিন নামাজে যাওয়ার আগে বিজোড় সংখ্যায় খেজুর খেতেন।
মিষ্টি খাবার গ্রহণের মাধ্যমে আমরা ঈদের দিনের আনন্দ ও শুভকামনা প্রকাশ করি।
৪. ঈদগাহের পথে তাকবিরের ধ্বনি
ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য ঈদগাহের দিকে হেঁটে যাওয়া সুন্নত। ঈদগাহে যাওয়ার পথে উচ্চস্বরে তাকবির পাঠ করা হয়। তাকবিরের ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তোলা যেন ঈদের আনন্দেরই একটি অংশ।
৫. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে গমন
শারীরিকভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্য পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া উত্তম। এর মাধ্যমে বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ পায়। এছাড়াও, পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়ার মাধ্যমে সমাজের গরিব-দুঃখী মানুষের প্রতি সহানুভূতি তৈরি হয়।
৬. ভিন্ন পথে ঈদগাহ থেকে ফেরা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদগাহে এক পথে যেতেন এবং অন্য পথে ফিরে আসতেন। এর পেছনে অনেক তাৎপর্য রয়েছে। একটি কারণ হলো, উভয় পথের মানুষজনের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। এছাড়াও, কিয়ামতের দিন ঈদগাহের উভয় পথের মাটি সাক্ষ্য দেবে।
৭. ঈদের নামাজ জামাতে আদায়
ঈদুল ফিতরের প্রধান আকর্ষণ হলো ঈদের নামাজ। এই নামাজ জামাতে আদায় করা সুন্নাতে মুআক্কাদা। ঈদের নামাজে অতিরিক্ত তাকবিরের মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা হয়। নামাজের পর ইমাম সাহেব খুতবা দেন, যা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ।
৮. শুভেচ্ছা বিনিময়ে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন
নামাজ শেষে একে অপরের সাথে “ঈদ মোবারক” বলে শুভেচ্ছা বিনিময় করা সুন্নত। এর মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার বন্ধন আরও দৃঢ় হয়।
৯. জাকাতুল ফিতর: ঈদের আনন্দের ভাগ
ঈদের দিনে দরিদ্র ও অভাবী মানুষের মাঝে জাকাতুল ফিতর বিতরণ করা ওয়াজিব। এর মাধ্যমে সমাজের দরিদ্র মানুষরাও ঈদের আনন্দে শামিল হতে পারে। জাকাতুল ফিতর ঈদের আনন্দের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা সমাজের সবার মাঝে আনন্দ ছড়িয়ে দেয়।
১০. আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গমন
ঈদের দিনে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া এবং তাদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করা সুন্নত। এর মাধ্যমে সম্পর্ক আরও মজবুত হয় এবং পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।
১১. আনন্দময় খাবার আয়োজন
ঈদের দিনে ভালো খাবার রান্না করা এবং পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের সাথে একসাথে খাওয়া সুন্নত।
১২. দুস্থদের প্রতি সহানুভূতি
ঈদের দিনে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের প্রতি সহানুভূতি দেখানো এবং তাদের সাহায্য করা একটি মহৎ কাজ।
উপসংহার: ঈদুল ফিতর শুধু একটি আনন্দ উৎসব নয়, এটি তাকওয়া ও মানবতার জয়। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আমরা যে সংযম ও আত্মশুদ্ধি অর্জন করি, তা যেন আমাদের সারা জীবনের পাথেয় হয়।
আসুন, আমরা সবাই মিলে ঈদুল ফিতরের সুন্নতগুলো পালন করি এবং ঈদকে আরও সুন্দর ও অর্থবহ করে তুলি। ঈদ মোবারক!