শাওয়াল মাসের ফজিলত ও ৬ রোজা রাখার নিয়ম
ইসলামি ক্যালেন্ডারের দশম মাস শাওয়াল, মুসলিম জীবনে এক গম্ভীর তাৎপর্যের অধিকারী। বহুবিধ ফজিলতের আবরণে মোড়ানো এ মাসটি একদিকে যেমন ঈদের আনন্দ নিয়ে আসে, অপরদিকে তা আত্মিক প্রশান্তি, নফল ইবাদত এবং রমজানের ধারাবাহিকতা রক্ষার এক অনন্য সুযোগও এনে দেয়।
রমজান ছিল আত্মশুদ্ধির আয়োজন, আর শাওয়াল তার পরিপূরক সাধনা। যে রমজান শেষে ফিরে যায় পূর্ববর্তী অবস্থায়, সে যেন এক অনন্ত সম্ভাবনাকে হারায়। শাওয়াল তাই এক আত্মজিজ্ঞাসার মাস, সংযমের শিক্ষা ধরে রাখার এক প্রশান্তিপূর্ণ ধাপ।
শাওয়াল মাসের ফজিলত কি?
হাদীসে নববীতে শাওয়াল মাসের ছয় রোজা নিয়ে এসেছে এক আশ্চর্য ফজিলত:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি রমজান মাসের রোজা রাখে, অতঃপর শাওয়ালে ছয়টি রোজা রাখে, সে যেন পুরো বছরের রোজা পালন করলো।” (সহীহ মুসলিম: ১১৬৪)
শাওয়াল মাসের ৬ রোজা রাখা কি ফরজ?
ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে রমজানের পর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখা ফরজ নয়—বরং এটি একটি মুস্তাহাব আমল, অর্থাৎ প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসৃত একটি প্রশংসনীয় ইবাদত। তবে এর গুরুত্ব নিছক একটি নফল কাজের সীমায় আবদ্ধ নয়।
বরং এই ছয় রোজা যেন আত্মার সেই পরিশুদ্ধ প্রবাহ, যা রমজানের প্রশিক্ষণকে জীবন্ত রাখে। এ রোজাগুলো আত্মাকে সজাগ করে, ইমানের শিখা নিভে না যেতে সহায়তা করে। যেন রমজানের অনন্য প্রশান্তি ও আত্মিক উজ্জ্বলতা শাওয়ালের ছায়াতলে এসে মলিন না হয়।
শাওয়ালের ৬ রোজা রাখার বিধান কী?
এই রোজাগুলো ফরজ নয়, বরং মুস্তাহাব (উত্তম ও সুন্নাহসম্মত)। এগুলো পালন না করলে গোনাহগার হওয়ার বিধান নেই, তবে এর ফজিলত অর্জন থেকে বঞ্চিত হওয়া—এটা এক প্রকার আত্মিক ক্ষতিই বটে। শাওয়ালের ছয় রোজা রাসূলের সুন্নাহ, সাহাবায়ে কেরামের অভ্যাস এবং সালাফদের প্রচলিত আমল।
শাওয়ালের ৬ রোজা কোন কোন দিন রাখতে হয়?
শাওয়াল মাসে, ঈদের দিন বাদে যেকোনো দিন এই রোজা রাখা যায়। ঈদের দিন (১ শাওয়াল) রোজা রাখা হারাম। অতএব, ২ শাওয়াল থেকে মাসের শেষ দিন পর্যন্ত যেকোনো ছয় দিন বেছে নেওয়া যায়। এতে নির্দিষ্ট কোনো দিনের শর্ত নেই।
শাওয়ালের ছয় রোজা রাখার নিয়ম কী?
শাওয়ালের ছয় রোজা রাখার ক্ষেত্রে শরীয়তে কোনো বাধ্যতামূলক নির্দিষ্ট ধারাবাহিকতা নেই। কেউ চাইলে রমজানের পরপরই একটানা ছয় দিন (ঈদের দিন ব্যাতীত) রোজা রাখতে পারেন—যা বহু সাহাবায়ে কেরামের আমল থেকেও প্রমাণিত।
আবার কেউ যদি ব্যস্ততা কিংবা শারীরিক সক্ষমতার কারণে ফাঁকে ফাঁকে আলাদা দিনেও রাখেন, তবুও তাতে কোনো আপত্তি নেই। মূল কথা—এই ছয়টি রোজা শাওয়াল মাসের মধ্যেই সম্পন্ন হওয়া উচিত।
নারীদের জন্য করণীয় কী? কাজা আগে, না নফল?
এ বিষয়ে ফিকহবিদগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে অধিকাংশ ফকীহের মতে, নারীদের জন্য প্রথমে রমজানের কাজা রোজা পূরণ করে এরপর শাওয়ালের নফল রোজা পালন করাই উত্তম।
শাওয়ালের ৬ রোজা না রাখলে গোনাহ হবে কি না?
না, এই ৬ রোজা না রাখলে কোন গোনাহ হবে না; কারণ এটি ফরজ নয়, মুস্তাহাব। তবে হাদীসে যে মর্যাদার কথা এসেছে, তাতে স্পষ্ট যে এই আমল রমজানের আত্মিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় এক অপরিহার্য সুযোগ। তা না রাখা মানে—উপহারস্বরূপ প্রাপ্ত এক বিশাল নেকীর ভান্ডারকে উপেক্ষা করা।
রমজানের পর আবার রোজা কেন?
এ প্রশ্নটি অনেকের মনে আসে। প্রকৃতপক্ষে, রমজান ছিল প্রশিক্ষণের মাস। এক মাস নিজেকে সংযমে আবদ্ধ করার পর শাওয়ালের রোজা সেই সংযমকে দীর্ঘস্থায়ী করার প্রচেষ্টা। এটি আত্মা ও আমলের ধারাবাহিকতাকে জীবিত রাখে। হঠাৎ এক মোহমুক্ত জীবন থেকে আবার মোহে ফেরানো যেন আর না হয়।
যারা রমজানে রোজা রাখতে পারেনি, তারা কি শাওয়ালের ৬ রোজা রাখতে পারবে?
না। হাদীসের স্পষ্ট শব্দ “রমজানের রোজা রাখার পর”। তাই কেউ যদি শরয়ি ওজরে (যেমন অসুস্থতা, হায়েয, সফর ইত্যাদি) রমজানের রোজা না রাখতে পারেন, তবে আগে সেই কাজা আদায় করতে হবে। এরপর শাওয়ালের ৬ রোজা রাখলে ইন শা আল্লাহ ফজিলত লাভ করবেন।
শাওয়াল মাসে আরও যেসব নেক আমল করা যায়
শুধু রোজা নয়, শাওয়াল হচ্ছে ঈদের পর পুনরায় আল্লাহমুখী হওয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ মাসে আরও কিছু আমল করা যেতে পারে:
- নফল নামাজ, বিশেষত তাহাজ্জুদ
- কুরআন তেলাওয়াত ও অধ্যয়ন
- সাদাকাহ প্রদান
- আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা
- ঈদের আনন্দে সীমালঙ্ঘন না করে পরিমিত চলা
শেষ কথাঃ শাওয়াল মাস আসলে আত্মার জন্য এক নীরব ডাক। এ ডাক রমজানের চেয়েও বেশি ব্যক্তিগত, বেশি গভীর। আল্লাহ আমাদের সামনে যে অফুরন্ত সওয়াবের দরজা খুলে দিয়েছেন, তা অযত্নে ছেড়ে দেওয়া আমাদের জন্য পরাজয়েরই নামান্তর।
আসুন, শাওয়ালের ছয় রোজাকে হালকাভাবে না দেখে, এর গুরুত্ব বুঝে একান্তভাবে আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ লাভ করি